শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥এইচ এম হেলাল: বয়স সম্ভবত ৪০ এর কোঠায়। লম্বা গড়ন, সুঠাম দেহের অধিকারী। বেশ-ভুষ ষোল আনাই রাজনৈতিক। কিন্তু চলন-বলনের স্টাইল কোন ধনকুব সাদৃশ্য। শশ্রু মন্ডিত এই যুবকের নাম আরিফিন মোল্লা। নিজ গ্রাম রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা তার পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটির বদলে নেতা হিসেবে একবাক্যে মেনে নিয়েছেন। আর চাইছেন উন্নয়ন। বিপরীতে আরিফিন মোল্লার প্রত্যাশা বরিশাল সদর আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় টিকিট। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন আঙ্গিকে সহায়তা এবং নানা সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে গত দু’ বছর ধরে তার পথচলায় যতটা না আলোচিত হয়েছেন, সে অপেক্ষা গত দু’ দিনে আরিফিন মোল্লা নামটি যেন আলোড়িত হয়েছে বেশি।
এতদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে ঘুরেফিরে একজন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় থাকলেও তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। হঠাৎ করে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ যেন মৌচাকে ঢিল মারলেন। প্রশ্ন তুললেন, আরিফিন মোল্লার দলীয় পরিচয় নিয়ে। সেই সূত্র ধরে একটি জাতীয় পত্রিকায় এই মনোনয়ন প্রত্যাশী নবাগত রাজনীতিবিদকে নিয়ে একটি নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের পর গোটা বরিশালেই তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন যে, গত দুই বছরে আরিফিন মোল্লা সমাজ উন্নয়নে ও দলের জন্য যে পরিমান শ্রম ব্যয় করে পরিচিতি আনতে সক্ষম হননি সে অপেক্ষা দ্বিগুন আলোচনায় আসলেন প্রকাশিত ওই সংবাদে। যার বিষয়বস্তু ছিল কে এই আরিফিন মোল্লা? তার পরিবার নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ মিশ্রিত ওই সংবাদে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নাকি বিব্রত বলে তুলে ধরা হয়। এখানেই যত বিপত্তি, ততো কথা। সংবাদটি যেদিন প্রকাশিত হয় সেদিনই আরিফিন মোল্লা তার কর্মী-সমর্থক ও একদল মিডিয়াকর্মীদের নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারতে যান। জানা গেছে, আরিফিন মোল্লা প্রকাশিত এই সংবাদের কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ এখনো করেননি। নীরব রয়েছেন। শুধু জোরালো দাবি করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন জামায়াত-বিএনপি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আদৌ সত্য নয়।
বহু পূর্ব থেকেই তার পরিবার আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত। এমনকি রংপুরস্থ তার মাতুল গোষ্ঠির সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সখ্যতা ও যাতায়াত ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দাবিদার আরিফিন মোল্লা ছাত্র জীবন থেকেই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে জড়িত বলে স্বদম্ভে জানালেন। তাহলে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যাদি ও আরিফিন মোল্লার দাবির মধ্যে কোনটি সত্য? এ নিয়ে নগরীতে তুমুল আলোচনায় বরিশাল নগর রাজনৈতিক অঙ্গন কিছুটা হলেও সরগরম হয়ে ওঠে। সদর (৫) আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশির সংখ্যা প্রায় পাঁচ জন। এর মধ্যে রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফিন মোল্লা ও চরবাড়িয়ার বাটনা এলাকার সালাউদ্দিন রিপন দু’জনকে নিয়েই বেশিমাত্রায় আলোচনা। অবশ্য এরা কেউই বরিশাল আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। কোন কমিটিতে তাদের নামও নেই। তারা নিজেরাও তা স্বীকার করেন।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, উভয়েই ব্যবসায়ীক সূত্রে বেশ ধনাঢ্য এবং রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ মনষ্ক। তাদের টার্গেটও অভিন্ন। রাজনৈতিক জোরালো কোন ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকায় দু’জন দুই প্রান্ত থেকে সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেদের সম্পৃক্তসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে নাম-ডাক ছড়াচ্ছেন। বলা যায়, আপনা-আপনি এই দুইজনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরী হয়েছে কে কার চেয়ে বেশি দান-দক্ষিনায় অগ্রগামী। পার্থক্য এখানেই, আরিফিন মোল্লা তার ব্যানার ও পোস্টারে নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে দাবি করেন। পক্ষান্তরে সালাউদ্দিন রিপন এস.আর সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে নিজেকে উপস্থাপন করেন। আরিফিন মোল্লা না পেলেও তিনি দলের জন্য কাজ করে যাবেন। কিন্তু সালাউদ্দিন রিপন মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পিছপা হবেন না। বাস্তব চিত্রে দেখা গেছে, বরিশাল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সাথে উভয়েরই সুসম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে সরবে উপস্থিত হতে দেখাও যায়। আবার দুই নেতা স্বীকারও করেন, তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক হচ্ছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহই। হঠাৎ করে এই পরিস্থিতিতে আরিফিন মোল্লাকে নিয়ে মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে সঙ্গত কারণে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নানা প্রশ্নের উদ্বেগ ঘটে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে- আরিফিন মোল্লা যদি জামায়াত-বিএনপি ঘরানার কেউ হয়েই থাকেন তাহলে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ব্যানারে তার মনোনয়ন চাওয়ার সুযোগ হলো কিভাবে? আর কেনই বা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এতদিন নীরব থাকলেন? সব থেকে বড় কথা, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সাথে সখ্যতা তৈরী হওয়ার কারণ কি? অথচ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল ও জেলা সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপি এই দুই দায়িত্বশীল নেতার অভিমত- তারা আরিফিন মোল্লার উত্থানে বিব্রত। কিভাবে দলীয় পরিচয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ডে আরিফিন মোল্লা সম্পৃক্ত হচ্ছেন তা নিয়েই কথা তোলেন। আরিফিন মোল্লার উত্থান প্রশ্নে এই দুই দায়িত্বশীল নেতার প্রতিক্রিয়ার সাথে রাজনৈতিক বাস্তবতা সাংঘর্ষিক হিসেবে নগরবাসী মনে করছে। কারণ যেখানে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এই যুবককে পথ চলতে প্রকাশ্যে আশির্বাদ দিচ্ছেন, সেখানে তার দলীয় অপর দুই নেতার বক্তব্য ও বিস্ময় প্রকাশের মাঝে এক ধরনের রহস্যের গন্ধ কোন কোন মহল খুঁজে পায়। কারো কারো অভিমত- এই ঘটনার মধ্যে কোন রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি নিহিত রয়েছে। আরিফিন মোল্লার নামে বিভিন্ন লঞ্চে বরাদ্দ থাকা কেবিন কোন একটি মহল অদৃশ্য ইশারায় বাতিল করার নির্দেশ দিচ্ছিল ঠিক তখনই তিনি সংবাদের শিরোনাম হওয়ায় এ সন্দেহ আরো প্রখর হয়।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সম্ভবত সালাউদ্দিন রিপন প্রতিহিংসামূলক আরিফিন মোল্লার বিরুদ্ধে মিডিয়াকে উসকে দিয়েছে। এ ধারণা করাটাও অমূলক নয়। কারণ জাতীয় ওই দৈনিক পত্রিকায় অনলাইন সংস্করনের সংবাদ ভাইরাল হয়ে যায় স্থানীয় বিভিন্ন অনলাইন দৈনিক পোর্টালে। পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় সংবাদটি। এমনকি স্থানীয় কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায়ও ফলাও করে আরিফিন মোল্লার বিরুদ্ধে একই সূত্রে গাঁথা অভিযোগ সমৃদ্ধ সংবাদ প্রকাশ পায় পরদিন। অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়, এর মধ্যে সালাউদ্দিন রিপনের কোন কারসাজি নেই। প্রকাশিত ওই জাতীয় পত্রিকার বরিশাল ব্যুরো প্রধানও স্বপ্রণোদিত হয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেননি। আওয়ামী লীগের উপরোক্ত শীর্ষ দুই নেতা আলোচনা থেকে আরিফিন মোল্লা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলায় সিনিয়র ওই রিপোর্টার সংবাদের রসদ পেয়ে যান। সেই সাথে রায়পাশা-কড়াপুর এলাকার বেশ কয়েকটি সূত্র আরিফিন মোল্লার পিতাকে বিএনপি ঘরানার এবং তার মাকে জামায়াতপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে তথ্য-উপাত্ত দেয়। স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি হচ্ছে- আরিফিন মোল্লা মাঠে নামার প্রথম ভাগে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিলেও নানা কারণে তা বন্ধ করে দেওয়ায় তাদের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। এসব কারণ একত্রিত হয়ে তৈরী হয়ে যায় আলোচিত ওই সংবাদ।
তলিয়ে দেখা যায়, আসলে বরিশাল আওয়ামী লীগের একটি অংশ আরিফিন মোল্লার উত্থান কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। আবার আরিফিন মোল্লার প্রশ্নে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে ভুলভাল বোঝাতেও পারছে না। কৌশল হিসেবে মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে এমন একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরীর চেষ্টা করা হয়েছে যাতে আরিফিন মোল্লা বিব্রতকর অবস্থার মাঝে রণভঙ্গ দেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে বলে পরিস্থিতি বলছে। আরিফিন মোল্লা নয়, বরং আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে নিজ ঘরানার নেতৃবৃন্দ। আত্মঘাতী এই পরিস্থিতিতে কিভাবে সামাল দেবে বরিশাল আওয়ামী লীগ সে উত্তর জানার চেষ্টায় যোগাযোগ করা হয়েছিল বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতার সাথে। তারা এই মুহূর্তে নিজেদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে একটি পরিস্কার ধারণা মিলবে।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আরিফিন মোল্লাকে নিয়ে তোলপাড় পরিস্থিতি সম্পর্কে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ অবগত হয়েছেন। আপাতত মিডিয়াকে সামাল দিতে মনোনয়ন প্রত্যাশি এই যুবককে একটি গাইডলাইন বাতলে দিয়েছেন। এতে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন আরিফিন মোল্লা। তিনি কোন বিরোধ বা বেফাঁস মন্তব্য না করে চৌমাথা থেকে রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের পাকা সড়কের খানাখন্দে নিজ অর্থায়নে ইট ফেলে উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা শোনা যায়, দেখাও যায়।
Leave a Reply